প্রতিবেদন: আসলাম উদ্দিন
“কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না— নিশ্চল নিশ্চুপ, আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।”
নিজেরই লেখা এই চরণ যেন একদিন তাঁর জীবনকথার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম—সাম্য, প্রেম আর দ্রোহের কবি। ধূমকেতুর মতোই তিনি এসেছিলেন, আর রেখে গেছেন আলো-আগুনের অমোঘ রেখাপথ।
আজ ১২ ভাদ্র, বাংলা সাহিত্যের সেই বিদ্রোহী প্রাণপুরুষের প্রয়াণের পঞ্চাশ বছর। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে নির্বাক কবির জীবনাবসান ঘটে ঢাকায়। তিনি রেখে যান অগণিত কবিতা, গান, নাটক আর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উজ্জীবিত করার অনিঃশেষ প্রেরণা।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে, বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া নজরুলের জীবন ছিল এক বৈচিত্র্যময় সংগ্রাম। কখনও লেটো দলে গান গাওয়া, কখনও সেনাবাহিনীতে সৈনিক হওয়া কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা—প্রতিটি অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকে করেছে গভীর, করেছে বাস্তব।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ১৯২২ সালে যে ঝড় তিনি তুলেছিলেন, তা শুধু সাহিত্যেই নয়, সমগ্র জাতির চেতনাকেও নাড়া দিয়েছিল। শোষণ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অগ্নিঝরা কলম মানুষকে দিয়েছে সাহস, দিয়েছে স্বপ্ন। একই সঙ্গে তিনি রচনা করেছেন প্রেম, মানবতা আর অসাম্প্রদায়িকতার অনবদ্য সুর। ইসলামী গজল থেকে শ্যামাসংগীত, প্রার্থনা থেকে প্রেম—তাঁর কণ্ঠে সবকিছুই ছিল সমান আপন।
প্রায় তিন হাজার গান লিখে ও সুরারোপ করে তিনি বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন নজরুলসংগীত নামের অমূল্য ভান্ডার। তাঁর সৃষ্টিতে মিলেছে বিদ্রোহ আর মমতার অনন্য সংমিশ্রণ—যেন অগ্নিবীণার ঝংকারে ভেসে আসা প্রেমের মৃদু সুর।
তবে মধ্য বয়সেই দুরারোগ্য ব্যাধি পিক্স ডিজিজ তাঁকে কেড়ে নেয় সাহিত্য থেকে। নির্বাক জীবনের দীর্ঘ নীরবতার পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁকে আপন করে আনে, দেয় জাতীয় কবির মর্যাদা। ১৯৭৬ সালে তিনি চলে যান চিরনিদ্রায়, শায়িত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।
নজরুল আজ নেই, কিন্তু তাঁর কলম, তাঁর গান, তাঁর স্বপ্ন আমাদের মধ্যে জ্বালিয়ে রেখেছে অমর শিখা। তাঁর প্রয়াণের অর্ধশতক পরেও তিনি আমাদের প্রতিবাদে সাহস, প্রেমে অনুরাগ, আর মানবতায় আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন।

